(লেখাটি বাস্তব জীবনকে কেন্দ্র করে কল্পনার আলোকে লেখা হয়েছে।
তবে একটি ক্ষুদ্র অংশ বাস্তব জীবন থেকে সরাসরি নেয়া হয়েছে)
“আমগর দিকে কে তাকায়?”
ফজরের নামায শেষে সেলিনা হাশেম এবং সাকিবের জন্য খাবার প্রস্তুত করায় ব্যস্ত। পাঁচটি রুটি আর আলু ভাজি। হাশেম নাস্তা খেয়ে বের হয়ে গেল। সাকিবের কাজের যায়গায় যেতে ২ ঘণ্টা লাগে। সে সকাল ৭ টায় বের হয়ে গেল। দেরিতে পৌঁছালে বকা শুনতে হবে। বয়স ২৩ তার; ঢাকার এক বস্তিতে থাকে তারা। তার সারাদিন কেটে যায় ইট আর সিমেন্ট নিয়ে। ভবনের পঞ্চম তলায় কাজ চলছে। মাঝখানে নাস্তা আর নামাযের বিরতি পায়। ইট আর সিমেন্টের বোঝা বহন করে যা আয় করে, সেটি মায়ের হাতে তুলে দেয় সে। মা নিজের সন্তানকে সন্ধ্যা ছাড়া পান না। ছেলেটি কাজ করে এসে বিশ্রাম নিয়ে পড়ালেখা শুরু করে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু একটা করার ইচ্ছা তার। মা একসময় মানুষের ঘরে কাজ করতেন। ছেলেকে কখনও কাজে পাঠাতে চাননি তিনি। কিন্তু এখন আর বুয়ার কাজ করতে পারেন না। যিনি রুটিন অনুযায়ী ঘরে ঘরে কাজ করতেন, তিনি আজ অকালে কোমরের যন্ত্রণায় কাবু। শরীর আর চলে না। শেষ পর্যন্ত নিজের সন্তানকে কাজে পাঠাতে হলো। সারাদিন ছেলের মুখ দেখার জন্য তাঁর মনে এক অজানা টান কাজ করে। মায়ের সময় কাটে ভয়ে, একদিকে ছেলে কাজ করতে গিয়ে ব্যাথা পাচ্ছে কিনা অন্যদিকে স্বামী প্রধান সড়কে কতটুকু ঝুঁকি নিয়ে রিকশা চালাচ্ছেন তা নিয়ে। আল্লাহ্র কাছে দোয়া করে শান্তি পান তিনি, ভরসা পান। এভাবে কেটে যায় দিন। হাশেম রিকশা নিয়ে যে সকালে বের হয়, রাতে কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। রাতে এসে ছেলেকে পড়তে দেখে মনে অনেক শান্তি পান তিনি।
হাশেম মানুষটা সহজ সরল, কাউকে ঠকাতে চান না তিনি। তবুও উচ্চ শ্রেণির কিছু মানুষের মুখের কথার সম্মুখীন হতে হয়। আজ বিকালে তিনি অনেক ক্লান্ত, সারাদিন টানা রিকশা চালিয়েছেন। মাঝে শুধু একবার কয়েকটি বিস্কুট আর চা খেয়েছেন। ঢাকায় যা গরম তাতে রিকশা চালানো বড়ই কঠিন। বিকালে গরম কম বলে শ্যামলী বাস স্ট্যান্ড এর সামনে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ছাত্র; বয়স ১৭ বা ১৮ হবে, এসে সালাম দিয়ে বলল, “আঙ্কেল, তাজমহল রোড যাবেন?”। তিনি অবাক হলেন যে একজন রিক্সাওয়ালাকে কেউ সালাম দিচ্ছে। ছেলেটির মা আসলো। তিনি ছেলেটিকে বললেন, “বাবা, এখন আমি অনেক ক্লান্ত, অন্য কোন রিকশা দেখতে পারবা?”। “আজ এখানে কোন রিকশা দেখছিনা, কোচিং এ দেরি হলে সমস্যা হবে। আজ পরীক্ষা যে!”। ছেলেটির প্রতি তাঁর মায়া হলো, ক্লান্ত হলেও ছেলেটির পরীক্ষার কথা ভেবে তিনি রাজি হলেন। “তাজমহল রোডের কোথায় যাবেন?”, ছেলেটির মা বললেন, “হক বেকারির পাশের বিল্ডিং, ভাড়া কত নিবেন?”। “আপা, আপনের ছেলে যেভাবে সালাম দিয়া মিষ্টি সুরে কথা কইসে, এমনে আচরণ করলে বিনা পয়সায় নিয়া যাইতে রাজি থাকমু। অহন তাড়াতাড়ি উঠেন নাইলে দেরি হইয়া যাইব। যা ভাড়া তা দিয়েন”। ছেলেটি প্রথমে অবাক হলো, এরপর হাসি মুখে রিকশায় উঠলো। কোচিং এর সামনে নেমে মাকে সালাম আর বিদায় দিল, তারপর রিকশাওয়ালাকে সালাম দিয়ে দ্রুত কোচিং সেন্টার এ ঢুকে গেল। “৪০ টাকা দিচ্ছি, হবে?”। “হ আপা হইব, আর লাগব না। আপনার ছেলেরে আপনে অনেক ভালা শিক্ষা দিছেন, দোয়া করি একদিন অনেক বড় মানুষ হইব সে”। মায়ের চোখে পানি এসে গেল, বললেন, “এভাবে কেন বলছেন?”। “এইডাই আমার কাছে অনেক বড়, আমগর দিকে কে তাকায়?”
এরপর একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার রিকশা নিয়ে চলা শুরু করলেন তিনি। রিকশা নিজের নয়, প্রতিদিনের আয়ের
একটা অংশ মালিককে দিতে হয়। বাকি যা থাকে তা
দিয়ে আর ছেলের আয় দিয়ে সংসার চলে। সন্ধায় ছেলে বাসায় আসার পর মা বললেন, “বাবা এত কষ্ট
করস কেন? অন্য সহজ কাজ দেখ না, এত বিপদের কাজ করিস না আর”। “আম্মা, কি কন? আমরা এই
কাম না করলে বাড়ি বানাবো কারা?”।
লেখক,
রাফসান জাহিন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন